মহাস্থানগড়ে বছরে ৪০ কোটি টাকার কটকটি কেনাবেচা

মহাস্থান প্রতিনিধিঃ ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় ঘিরে গড়ে ওঠা কটকটির দোকানকে কেন্দ্র করে ৫ শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী শ্রমিক রয়েছেন।

সুগন্ধি চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি কটকটি। একে গুড় বা চিনির ঝোলে ডুবালেই হয় দারুণ মিষ্টি। বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে তৈরি অতুলনীয় স্বাদের এই কটকটির চাহিদাও ব্যাপক। এখানে বেড়াতে এসে কেউ এই কটকটির স্বাদ নেয়নি বা কিনেননি এমনটি ভাবাও দায়। ফলে মহাস্থানগড়কে ঘিরে গড়ে ওঠা শতাধিক দোকানে বছরে অন্তত ৪০ কোটি টাকার এই পণ্য বেচাকেনা হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় ঘিরে গড়ে ওঠা কটকটির দোকানকে কেন্দ্র করে ৫ শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী শ্রমিক রয়েছেন। তারা কারখানায় কাজ করেন। মূলত কটকটি তৈরিতে এখানে নারীদের অবদানই বেশি বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন।

বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার উত্তরে বগুড়া-ঢাকা বিশ্বরোডের পাশে মহাস্থানগড় অবস্থিত। ঐতিহাসিকবিদদের মতে, করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে মানবসভ্যতা গড়ে ওঠে। পরে হজরত শাহ্ সুলতান বলখী (রহ.) মাহী সওয়ারের মাজারকে কেন্দ্র করে এখানে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। প্রতিদিন এলাকাটি ইতিহাসবিদ কিংবা দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। জনশ্রুতি রয়েছে এই মাজারের তবারক হিসেবেই প্রথমে আটার তৈরি কটকটির উদ্ভব হয়েছে। পরে স্বাদ ও মানের কারণে সাধারণের মধ্যে এর বাজারও প্রসারিত হয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, মহাস্থানগড় এখন ব্যাপক বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হয়েছে কটকটির দোকানের কারণে। লাল মিয়া কটকটি ঘর, নাসির কটকটি প্যালেস, হামু মামা কটকটি প্যালেস, সুলতান কটকটি প্যালেস, চায়না কটকটি ঘর, আলাউদ্দিন কটকটি ভান্ডার, জিন্নাহ কটকটি ভান্ডার, ফাতেমা কটকটি প্যালেস, আল আমীন কটকটি প্যালেস, লায়েব কটকটি ভান্ডার, শাহাদত কটকটি ভান্ডারসহ শতাধিক কটকটির দোকান দেশের মানুষের কাছে বিশ্বস্ততার সঙ্গী হয়েছে।

মহাস্থানগড়ের উপর গত ৫ বছর ধরে অস্থায়ীভাবে কটকটির দোকান করছেন নূর নবী। তার দোকানে তিন রকমের কটকটি পাওয়া যায়। ভাজার ভিন্নতার কারণে কটকটি তিন রকমের হয়। তেলে ভাজলে স্বাদ এক রকম। ডালডা দিয়েও ভাজা যায়। আবার ঘিয়ে ভাজলে তার স্বাদ অসাধারণ লাগে।

নূর নবী বলেন, “সাধারণত প্রতিদিন আমি ১০০ কেজির উপরে কটকটি বিক্রি করি। শুক্রবার হলে বেচাকেনা ৫০০ কোজির উপরে হয়। এই হিসেবে গড়ে ২০০ কেজি কটকটি বিক্রি হয় আমার দোকান থেকেই। গড়ে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি হলে প্রতিদিন ২৪ হাজার টাকার বিক্রি হয়। বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত এক লাখ টাকা।”

তবে এই বাজারে মাসে বা বছরে কী পরিমাণ কটকটি বিক্রি হয় তার কোনো পরিসংখ্যান নেই ব্যবসায়ীদের কাছে। গড় হিসাবে দেখা গেছে, বছরে ছয়মাস (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) মহাস্থানগড়ে পর্যটন মৌসুম ধরা হয়। এই সময়ে গড়ে অন্তত প্রতিদিন আড়াইশ মণ কটকটি বিক্রি হয়। বছরে প্রতিদিন বিক্রি হয় ২০০ মণ। এই হিসেবে মাসে ৬ হাজার মণ, বছরে ৭২ হাজার মণ কটকটি কেনাবেচা হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখানে ১২০ থেকে শুরু করে ২০০ টাকা কেজি দরে কটকটি কেনাবেচা হয়। গড় মূল্য ১৪০ টাকা করে হলে ৭২ হাজার মণ কটকটির দাম দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৩২ লাখ টাকা।

সুস্বাদু এই খাবারের জন্য মহাস্থানগড়ের নাসির কটকটি ভান্ডার স্থানীয়রা এক নামেই চেনে। তাদের ভাষ্য, স্বাদের ভিন্নতার কারণেই এই পরিচিতি তাদের। অন্য দোকানের চেয়ে এখানে দামও বেশি। এই দোকানে খেজুরের গুড়ের তৈরি কটকটির কদরও রয়েছে বেশ।

এই প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ বছর ধরে কাজ করছেন ফুলমিয়া। জানালেন, ‘আমাদের কটকটি সবার থেকে আলাদা। এখানে প্রতিদিন অন্তত ২০ মণ কটকটি বিক্রি হয়। শুক্রবারে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হয়। খেজুরের গুড়ের কটকটির কারণে কাস্টমার আরও বেড়েছে। প্রতি কেজির দাম ২০০ টাকা। আর রেগুলার কটকটি ১২০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি। তবে ডালডায় ভাজা ১৪০ টাকা কেজির কটকটির চাহিদাই বেশি।’

এই হিসেবে শুধু নাসির কটকটির দোকানে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ টাকার উপরে কটকটি কেনাবেচা হয়ে থাকে। অর্ধশত বছর আগে থেকে চলমান নাসির কটকটি ভান্ডার এখন পরিচালনা করেন তার ছেলে শহিদুল ইসলাম রঞ্জু।

এই ব্যবসায়ী জানান, তার প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে দোকানে তিনজন, ১০ জন কারখানায়। সেখানে ৬ জনই নারী রয়েছেন। আগে কটকটির ব্যবসা খুব ভালো হলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। ছোট ছোট অনেক উদ্যোক্তা লাভ কম হওয়ার কারণে ঝরে পড়তে পারেন।

স্বামী মাহবুবের সাথে প্রায় ১২ বছর ধরে কটকটির কারিগর হিসেবে কাজ করছেন সালমা বেগম। মহাস্থানগড়ের উপর তাদের অস্থায়ী একটি দোকানও রয়েছে। তার বেড়ে ওঠাও মহাস্থান এলাকায়। মহাস্থানের পাশেই নানাবাড়িতে ছোটবেলায় কটকটি তৈরি শেখেন সালমা।

জানান, বিয়ের পর থেকে স্বামীর সাথে কটকটি তৈরি করে তা বিক্রির টাকায়ই সংসার চলে। কটকটির ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে তারা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। সেই ঋণের বোঝা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন।

সালমা বলেন, ‘টিভিতে দেখি সরকার কতো মানুষকে ঋণ দেয়। আমাদের কেন দেয় না? সরকার কম সুদে ঋণ দিলে তো আমাদের এনজিও থেকে বেশি সুদে ঋণ নেওয়া লাগতো না।’

সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে কটকটির বাজারে অস্থিরতা চলছে বলে জানালেন সালমার স্বামী মাহবুব। ‘আগে এক কেজি গুড়ের দাম ছিল ৪৫ টাকা, এখন ৮৩ টাকা। ৯০০ টাকার ডালডা (১৬ কেজির একটি কার্টন) এখন কিনতে লাগে ২৮০০ টাকা। তেলের কথা তো আপনারাই জানেন। এ কারণে কটকটি বিক্রির লাভ এখন অর্ধেক হয়েছে। তবে বিক্রি আগের মতোই রয়েছে।’

গত সোমবার নওগাঁর ধামুইরহাটের খেলনা গ্রাম থেকে মহাস্থানগড়ে এসে কটকটি কিনছিলেন মো. আইয়ুব আলী। জানান, ‘আমরা এক বাস মানুষ এখানে মাজার জিয়ারত করতে এসেছি। এর সাথে কটকটি কিনে নিয়ে যাচ্ছি। এই ঐতিহাসিক কটকটি না কিনলে এখানে আসা পূর্ণতা পায় না।’ একই গ্রামের বাসিন্দা হোসেন আলী বলছেন, ‘দাম যেমনই হোক, এই কটকটির স্বাদই আলাদা। এমন কটকটি দেশের কোথাও পাওয়া যায় না। অনন্য স্বাদ।’

কটকটি তৈরি পদ্ধতি

ব্যবসায়ী ও কারিগরেরা জানান, কটকটির ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা কারও নেই। তবে শুরুর দিকে গমের আটা দিয়ে কটকটি তৈরি করা হতো। পরে এটির পদ্ধতি ও উপকরণে পরিবর্তন আনা হয়। আগে শুধুমাত্র তেলে ভাজা হলেও এখন কটকটি ভাজতে ঘি কিংবা ডালডা ব্যবহার করা হয়।

কটকটি তৈরির প্রধান উপকরণ সুগদ্ধি চাল। এই চাল প্রথমে তিন থেকে চার ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এতে চাল নরম হয়ে যায়। ওই চাল ছেঁকে পানি শুকিয়ে ফেলতে হয়। চাল ঝরঝরে হতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগতে পারে। এরপর চাল আটায় রূপান্তর করা হয়। আগের দিনে আটা তৈরি করতে ঢেঁকির প্রচলন ছিল। এখন সাধারণত মেশিনে আটা তৈরি করা হয়। এরপর আটার সঙ্গে কিছুটা তেল মিশিয়ে খামির করা হয়। এই খামির কোনো ধাতবে বিছিয়ে হালকা শক্ত করতে হয়। পরে প্রায় দেড় বর্গইঞ্চি করে ছাঁচে ফেলে চাকু দিয়ে কাটা হয়।

এই বর্গাকৃতির কাঁচা কটকটি ভোজ্য তেল, ঘি কিংবা ডালডার সংমিশ্রণে ভাজা হয়। এটি লালচে রং ধারণ করলে কড়াই থেকে তোলা হয়। এরপর গুড় বা চিনি দিয়ে তৈরি করা বিশেষ ঝোলে ভাজা কটকটি বড় কড়াইয়ে নিয়ে নাড়তে হয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঠান্ডা হয়ে গেলেই হয়ে যায় দারুণ স্বাদের কটকটি।

মহাস্থানের মাজার ও কটকটির ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলেন, একসময় এই কটকটি শুধুমাত্র মাজারের তবারক হিসেবে তৈরি করা হতো। কিন্তু এখন এর চাহিদা ব্যাপক আকারে বেড়েছে। এখন বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসলেও এই কটকটি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। সুস্বাদু এই খাবারটি শুধু বগুড়াতেই পাওয়া যায়। বগুড়ার ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে এই কটকটি। এই খাতকে বিকশিত করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন বগুড়ার ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সরকারের তরফ থেকে ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের কম সুদে ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। উদ্যোক্তারা আবেদন করলে আমরা ঋণ দিব। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।’

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ