উলিপুরে কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে জুগি চুন

উলিপুর প্রতিনিধিঃ শত বছর ধরে বংশ পরস্পরায় ঝিনুক দিয়ে জুগি চুন তৈরির সাথে যুক্ত থাকায় এলাকার নাম হয়েছে জুগিপাড়া।

কুড়িগ্রামের উলিপুর পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডে এই জুগিপাড়া। কিন্তু দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনুক থেকে চুন তৈরির শিল্প। বর্তমানে চুন তৈরির উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ বেশি, বাজারে চুনের দাম কম হওয়ায় তেমন লাভ নেই বলে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন, পেশাদারী চুন তৈরির কারিগররা। ফলে অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন বাপ-দাদার তিন পুরুষের পুরোনো এই পেশা। উলিপুর পৌরসভা ও উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নে পুরোনো এই পেশাটি টিকিয়ে আছে মাত্র গুটিকয়েক কারিগরের হাত ধরে।

চুন তৈরির প্রধান উপকরণ হলো শামুক-ঝিনুক। জলবায়ূ পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবে বিলুপ্তির পথে চুন তৈরির কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত প্রধান উপকরণ এই শামুক ও ঝিনুক। পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালায় মাছ ও ধান উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারে শামুক-ঝিনুক কমে যাচ্ছে। চুন তৈরির উপকরণের দাম বাড়লেও বাড়েনি চুনের দাম। ফলে লোকসানের মুখে পড়েছে এই পেশার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা।

কিভাবে চুন তৈরি করা হয় চুন তৈরির কারিগরদের নিকট জানা গেছে, চুন তৈরির প্রধান উপকরণ হলো শামুক-ঝিনুক। প্রথমে শামুক-ঝিনুকের খোসা আলাদা করতে হয়। পরে চুলা বা ভাটায় খড়, কাঠের খরি, শামুক-ঝিনুকের খোসাগুলো পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে আগুনে পোড়াতে হয়। এক সময় আগুনে খোসাগুলো পোড়ানোটাও কষ্টসাধ্য ছিলো এখন সহজে চুলার মুখে আগুন দিয়ে বৈদ্যুতিক পাখার সাহায্য বাতাস দিয়ে পোড়ানো হয়। আগে বাতাসের জন্য হাত পাখা ব্যবহার করতে হতো। এভাবে ৩-৪ ঘন্টা আগুনে পোড়ানো হলে শামুক-ঝিনুকের খোসাগুলো পুড়ে সাদা রং ধারণ করে। পোড়া খোসাগুলো চুলা থেকে নামিয়ে গুড়া করে চালুনি দিয়ে চেলে নিতে হয়। এরপর চেলে নেয়া পরিস্কার গুড়াগুলো মাটির চারিতে পানি মিশিয়ে নিতে হয়। পানিতে মেশানো গুড়োগুলো কাঠ বা বাঁশের হাতা দিয়ে দেড় থেকে দুই ঘন্টা ঘুটলে চুনের সাদা রং বের হয়ে এসে তৈরি হয় পান খাওয়ার চুন। জুগি চুনের কদর আছে এ এলাকার মানুষের কাছে।

চুন তৈরির কারিগর ষাটোর্ধ্ব শাকিল দেবনাথ জানান, ১০ বছর বয়স থেকে এই পেশায় জড়িত আছি। বর্তমানে পেশা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। একবস্তা ঝিনুকের খোসার দাম এখন সাড়ে ৩’শ থেকে ৪’শ টাকা। আনতে খরচ হয় ১০০টাকা। এগুলো পুড়তে কাঠের খড়ি লাগে দেড় মণ যার মূল্যে সাড়ে ৪’শ টাকা ও ১জন লোক লাগে। যার আনুমানিক খরচ ১ হাজার ৪৫০ টাকা। প্রতিমণ চুন বাজারে বিক্রি হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪’শ টাকা পর্যন্ত। নিজের মজুরি ধরলে লাভতো দূরের কথা লোকসান গুণতে হয়।

একই তথ্য দিয়ে লক্ষণ দেবনাথ ও কিরণ বালা দেবনাথ দম্পতি জানান, চুনের তৈরিতে খরচ বেড়েছে কিন্তু চুনের দাম বাড়েনি। তাই চুনে লোকসান হওয়াতে অনেকে এ পেশা ছেড়ে নিয়ে দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে। বাপ-দাদার এই পেশাকে টিকিয়ে রাখতে পৌর শহরের জুগিপাড়া ও দুর্গাপুর ইউনিয়নের চন্ডিজান এলাকার ২৫-৩০ ঘর এখনও চুন তৈরি করে।

চুন উৎপাদনকারী সাগরিকা দেবনাথ জানান, শামুক ও ঝিনুকের গুড়া ১ হাজার ৮’শ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। একমণ ঝিনুকের গুড়া থেকে তিন থেকে সাড়ে তিনমণ চুন হয় তা বেচতে সময় লাগে প্রায় ১০ থেকে ১২ দিন। আমি চুন তৈরি করি ও আমার স্বামী সপ্তাহে দুইদিন উলিপুর বাজারে হাটের দিন চুন বিক্রি করে। সপ্তাহের বাকী দিনগুলো বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে চুন বিক্রি করে। কিন্তু চুন তৈরিসহ বিভিন্ন খরচপাতি বাদ দিয়ে যে লাভ হয় তা দিয়ে দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ, সংসার চালানো কঠিন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

চুন শিল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের তেমন কোন কদর নেই। সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ায় এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে পারে নাই অনেক পরিবার। চুন শিল্প রক্ষায় এখনও যে গুটিকয়েক ঘর এই পেশাকে ধরে আছে তাদেরকে সরকারি-বেসরকারি সহায়তার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসার কথা বলছেন এ পেশায় জড়িত তারাপদ দেবনাথ, মালতি রাণী দেবনাথ, মিন্টু দেবনাথসহ অন্য ব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কুড়িগ্রাম জেলার উপ-ব্যবস্থাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য উপজেলায় এই পেশায় জড়িতদের তালিকা করে সহযোগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেন।

Please follow and like us:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পুরানো সংবাদ